বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪

সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ
নারী ও যুবদের জীবনমান উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বাজেট প্রয়োজন
নারী ও যুবদের জীবনমান উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বাজেট প্রয়োজন

নারী ও যুবদের জীবনমান উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বাজেট প্রয়োজন

  
বাংলাদেশের কাঠামোতে স্থানীয় সরকারকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার শহর ও গ্রামীন। শহর পর্যায়ে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা। অপরদিকে গ্রামীন পর্যায়ে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ। শহর ও গ্রামীন এই ২টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক বা চেয়ারম্যান ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
এসব সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর আয়, ব্যায়ের একটি সম্ভব্য তালিকা প্রস্তাবনা করেন। যা বাজেট হিসাবে গণ্য হয়। এই বাজেটে জনসাধারণের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট, ড্রেন, ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি নির্মান করা হয়। পাশাপাশি মানবকল্যাণে নানামূখি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

তবে এই বাজেটে নারী ও যুবদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোন বরাদ্ধ রাখা হয় না। বেশিরভাগ বাজেট রাখা হয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। কিন্তু দেশের একটি বিরাট অংশই হচ্ছে নারী ও যুব সমাজ। যাদের বাদ রেখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। এতে দেশের একটি বড় অংশ জীবনমান উন্নয়ন করতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে। এতে করে সরকারের মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

নারী ও যুবদের জন্য জীবন দক্ষতার প্রয়োজন:  জীবন দক্ষতা হলো এমন কিছু দক্ষতা পদ্ধতি বা কৌশল যা কাজে লাগিয়ে মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে যেমন; সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবেলা এবং এর মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা। জীবন দক্ষতা শিক্ষার সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নানা ঝুঁকির পাশাপাশি উগ্রবাদ ও সহিংসতা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারা যায় এবং জীবনে এসব কৌশল কাজে লাগিয়ে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ জীবন গড়ে তোলা সহজ।
আমাদের জীবনে নানা সমস্যা আমাদের গ্রাস করে ফেলে। যার কারনে আমরা ভুল পথে চলে নিজেদের এবং সমাজের মানুষের জন্য হুমকির কারন হয়ে দাঁড়ায়। কারন জীবন দক্ষতার জ্ঞান না থাকায় অনেক যুবক ও নারী হতাশা, দারিদ্রতা, বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন। এতে করে অনেকে মাদক এবং নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পরিবারের চাপে, স্বার্থান্বেষী মহলের প্রলোভনে পড়ে মানুষ হত্যার মত কাজে নেমে পড়ছে যুবরা। পাশাপাশি নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন না হওয়ায় নানা অপকর্মে ও হতাশায় ঠেলে দিচ্ছে।

 নারী ও যুবদের প্রতিকূল অবস্থা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা সৃষ্ট করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে জীবন দক্ষতা। এতে তারা বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, মাদকাসক্তি, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এইচ আইভি/এইডস, নারী ও শিশু পাচার, বাল্য বিবাহ, যৌতুক, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন এবং সহিংসতার মতো অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। যা বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই কিংবা পরিবার থেকে শেখা যায় না। এতে নারী ও যুবদের দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিকূল অবস্থা ও সমস্যা মোকাবিলা এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।


এজন্য স্থানীয় সরকারের বাজেটে নারী ও যুবদের জন্য বিশেষ বরাদ্ধ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই বাজেটের মাধ্যমে ওয়ার্ড বা গ্রাম পর্যায়ে নারী ও যুবদের নিয়ে গ্রæপ করা যেতে পারে। প্রতি গ্রæপে জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ করতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি তাদের মধ্যে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল কাজ দেওয়া যেতে পারে। এমনই কি তাদের কে দিয়ে এলাকা ভিত্তিক জীবন দক্ষতা উন্নয়ন ক্লাব করা যেতে পারে। সেখানে জীবন দক্ষতা উন্নয়ন বিভিন্ন বই রাখা যেতে পারে। যারা বই পড়তে পারেন না তাদের জন্য ছবির মাধ্যমে পরিস্থিতি বোঝানো বা বই পড়িয়ে শোনার আসর করা যেতে পারে। প্রতিটি অঞ্চল থেকে যদি জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ আয়োজন করা যায় তাহলে সমাজের অনেক অপরাধ কমে আসবে। নারী ও যুবরা নিজের জীবনের সকল চ্যালেঞ্জ সঠিক ভাবে পার করতে পারবে। তাই নারী ও যুবদের উন্নয়নে জীবন দক্ষতার জন্য বিশেষ বরাদ্ধ জরুরী।

দক্ষ নাগরিক গড়তে বাজেট রাখতে হবে: জীবন দক্ষতার পাশাপাশি দক্ষ জনবল গড়ে তুলে দেশকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষিত নারী ও যুব সমাজ গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ জনবল গড়ে না ওঠায় সঠিক সেবা দিতে যেয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন সেক্টর।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) তথ্যমতে, দেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, তবে এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিভিন্ন খাতে মোট ৮ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। এই সময় পর্যন্ত দেশের ৯টি শিল্প খাতে নিয়োগ দিতে হবে আরও ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার নতুন শ্রমিক। এর মধ্যে দক্ষ শ্রমিক লাগবে ৮০ লাখ, আধা দক্ষ ৫৬ লাখ ও অদক্ষ শ্রমিক লাগবে ৩১ লাখ। অন্য এক পরিসংখ্যানমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় মোট রপ্তানি ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

পরামর্শ: দেশের নারী ও যুবদের কারিগরি বা প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এতে দেশের যুব ও নারীরা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তিত হবে। পাশাপাশি দেশের যেকোন বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাহিরের কোন শ্রমিক আনা লাগবে না। বরং দেশের টাকা দেশেই থাকবে। এজন্য কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কর্মমুখী শিক্ষাকে যত বেশি কার্যকর করা যায় তত বেশি দেশের উন্নয়নকে গতিশীল করা যাবে। তাই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমে দক্ষ জনবল গড়ার লক্ষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে দক্ষ জনশক্তিকে দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োজিত করতে হবে। আমাদের যেমন পোশাক শিল্পে প্রসার হয়েছে। পাশাপাশি আরো অনেক শিল্পের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে।

দেশের দক্ষ জনবল দিয়ে নতুন নতুন শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে। দেশের অনগ্রসর এলাকা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টি কামার-কুমার, তাঁতি, জেলে, ঋষি, কাহার, মুচি, ধোপা, কুলি সহ বিভিন্ন শ্রেণির পরিবারের যুবদের নিয়ে গবাদি পশু মোটা তাজাকরণ সহ বিভিন্ন অয়বর্ধন মূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ ঋণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া তরুন নারী ও যুবদের জন্য আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ শেষে সহজ কিস্থিতে ল্যাবটপ সহ বিভিন্ন উপকরণ সরবার করা যেতে পরে। আয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ল্যাপটবের মূল্য পরিশোধের ব্যাবস্থা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নারীদের জন্য বিভিন্ন হাতের কাজের উপর দক্ষতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন শেষে সেলাই মেশিন বা সংশ্লিষ্ট উপকরণ প্রদানের বরাদ্ধ রাখতে হবে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকান্ডে বেশি বরাদ্ধ রাখতে হবে। দক্ষ নারী ও যুব গড়ে তোলা হলে তাদের দক্ষতায় নিজেদেরকে কর্মে নিয়োজিত করতে পারবে। যা থেকে সম্মানের সাথে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। জেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর সভায় একটি যুব ও নারী বান্ধব ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করা যেতে পারে। যেখান থেকে নারী ও যুবরা ডিজাটাল সেবাভোগ করতে পারবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার তথ্য সহজে পেতে পারে। কোথায় কোন সেবা পাওয়া যায় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা নিতে পারবে। বিশেষ করে যুব উন্নয়ন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, কারিগরি প্রশিক্ষক কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ গুলো তথ্য পেলে যুব ও নারীদের উন্নয়ন ঘটবে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রশিক্ষনগুলো ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টারে প্রদান করা হলে প্রকৃতরা প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।

সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে লিংকেজ করে গ্রামীন যুবদের সেবার আওতায় আনতে পারলে যুব ও নারীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। করুনা নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী ও যুবরা সক্ষমতা অর্জন করবে। উচ্চশিক্ষা বা সনদ নির্ভর, ঢাকা ও বিদেশমুখি না করে আতœবিশ্বাসী, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, ইন্টারনেট দক্ষতা, লিডারশীপ, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা এবং ই-কমার্সের উপর জোর দিতে হবে। তাই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারী ও যুবদের জন্য বরাদ্ধ রাখা সময়ের দাবি।

লেখক: মীর খায়রুল আলম, সভাপতি, দেবহাটা প্রেসক্লাব।

About The Author

Related posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি থেকে বিরত থাকুন,ধন্যবাদ।