মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪

সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ
করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ; ইসলামী দৃষ্টিকোণ
করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ; ইসলামী দৃষ্টিকোণ

করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ; ইসলামী দৃষ্টিকোণ

প্রভাষক মুহাম্মাদ আসাদুজ্জামান ফারুকী খতিব, কলারোয়া থানা জামে মসজিদ। কলারোয়া, সাতক্ষীরা।

নভেল করোনাভাইরাস। চীনের উহানে প্রথমে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে। এতে প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এখানেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে বিশ্বের প্রায় ২২ লাখেরও বেশি মানুষ। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এ ভাইরাস থেকে আত্মরক্ষায় ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন (টিকা) আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশ্ববাসীর জন্য এটি একটি সুখবর। কিন্তু সম্প্রতি টিকা নেয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য। নানা বিভ্রান্তির নিরসন কল্পে এ লিখনি। ইসলামি শরিয়তের হুকুম হলো, ‘আল্লাহ রোগ দিয়েছেন; আল্লাহই ভালো করবেন। এ আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে যদি কেউ পথ্য বা ঔষধ গ্রহণ করে; তবে এটাই আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘প্রত্যেক রোগের শেফা রয়েছে।’মানুষ হয়তো গবেষণা করে সে রোগের ঔষধ বের করতে পারে অথবা পারে না। বর্তমান সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে করোনা ভাইরাসের যে টিকা আবিস্কার করেছেন সে বিষয়ে আমি বলবো- অন্তরে এ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহই রোগ ভালো করবেন। তাই ঔষধ ওসিলা হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো নিষেধ নেই। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ যদি সকালবেলা ৭ টি আজওয়া খেজুর খায় তাহলে তাকে কোনো রোগ স্পর্শ করবে না। এই যে রোগ হওয়ার আগে থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা’-এটি পবিত্র হাদিস থেকেই প্রমাণিত। সুতরাং টিকা কিংবা ভ্যাকসিন মানুষের জন্য সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এটি গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজ নয়। বরং এটা হাদিস অনুমোদিত ইসলামের অনেক বড় একটি শিক্ষা। পৃথিবীজুড়ে মানুষ এ ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য হাহাকার করছে। জীবনের নিভু নিভু আলো পুনরুজ্জীবিত করতে চাচ্ছে। এটা কোনো বিনোদনের বিষয় নয়। বরং বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আর ইসলামে জীবন রক্ষা করা ফরজ। তাই জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন (টিকা) ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামি শরিয়তের একটি স্বতঃসিদ্ধ উসুল আছে-‘প্রয়োজন কখনো কখনো নিষিদ্ধ কোনো কিছুকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বৈধতা দেয়।’ সুতরাং এ উসুলের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন ব্যবহারে ইসলামের কোনো বাধা নেই। যদিও এতে হারাম কিছু থাকে।’ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বৈধ-অবৈধ দ্বিধাদ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও কোনো কোনো ভ্যাকসিন কোম্পানি শূকরের চর্বি ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। সত্যিই যদি করোনার ভ্যাকসিন অথবা অন্য কোনো ওষুধে শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে দুটো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। প্রথমত, বিকল্প কোনো ওষুধ পাওয়া না গেলে জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম উপাদানে তৈরি ওষুধও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েজ। এ ব্যাপারে সুরা বাকারার ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘একান্ত নিরুপায় অবস্থায় গোনাহ করার ইচ্ছা ছাড়া শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাদ্য খেলে কোনো অপরাধ নেই।’ সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘গোনাহ করার ইচ্ছে ছাড়াই কেউ যদি জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে হারাম খায়, তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ এ দুটো আয়াত প্রমাণ করে, জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন মতো হারাম খেলে কোনো গোনাহ হবে না। করোনার ভ্যাকসিন তো আমরা খাচ্ছি না, শরীরে পুশ করছি মাত্র। জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাওয়া যদি জায়েজ হয়, তাহলে শূকরের চর্বি ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ব্যবহার করা কেন জায়েজ হবে না! হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) চর্মরোগে আক্রান্ত হলে রাসুল (স.) তাদের রেশমি পোশাক পরার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, রোগের কারণে হারাম বস্তু ব্যবহার করা জায়েজ। (ড. ইউসুফ আল কারজাভি, আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, ৭৬ পৃষ্ঠা।) সুরা আনআমের ১১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য যা যা হারাম করা হয়েছে, আল্লাহ তা সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন।’ এ সুরারই ১৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদিদের জন্য গরু ও ছাগলের চর্বি হারাম করেছি। তবে পিঠ-পেট ও হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা চর্বি হালাল ছিল।’ তার মানে, একটি প্রাণীর কী এবং কতটুকু অংশ হালাল বা হারাম তা আল্লাহর কিতাবে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়। সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হুররিমাত আলাইকুমুল মাইতাতু ওয়াদদামু ওয়া লাহমুল খিনজির। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে—মৃত পশু, রক্ত এবং শূকরের মাংস।’ লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, আয়াতে ‘লাহমুল খিনজির’ বলা হয়েছে। লাহমুন অর্থ গোশত। করোনার টিকায় শূকরের গোশত ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যবহার করা হচ্ছে চর্বি। চর্বির আরবি হলো শাহমু। তার মানে, শূকরের মাংস হারাম, চর্বি সরাসরি কোরআনের আয়াতের আলোকে হারাম নয়। আয়াতে ‘শূকরের মাংস’ শব্দটা খাস। শুধু মাংসই হারাম। চর্বি বা শূকরের অন্যান্য বিষয় যদি হারাম হতো, তাহলে আল্লাহ বলতেন, তোমাদের জন্য শূকর হারাম করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট করে ‘শূকরের মাংস’ বলে দিয়েছেন। ওষুধে ব্যবহৃত শূকরের চর্বি হারাম নয়। প্রক্রিয়াজাত করার ফলে চর্বি বা জেলাটিন থেকে শূকরের বৈশিষ্ট্য ও নাজাসাত দূর হয়ে যাওয়ার কারণে তা হালাল হয়ে যায়। সৈয়দ আমীর আলী ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলেছেন, শূকরের কোনো অংশ থেকে প্রক্রিয়াজাত করে নাজাসাত তথা অপবিত্রতা দূর করতে পারলে তা ব্যবহার করা জায়েজ হবে। হালাল প্রাণীর যেমন সবকিছুই হালাল নয়, তেমনি হারাম প্রাণীরও সবকিছু হারাম নয়। গরুর পেশাব-পায়খানা হারাম। কিন্তু গরুর গোবর যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়।

একবার একটি মৃত ছাগল দেখে রাসুল (স.) বলেছেন, তোমরা এর চামড়া শোধন করে ব্যবহার করো। সাহাবিরা বললেন, ওটা তো মরে গেছে। রাসুল (স.) বলেছেন, মরা ছাগল খাওয়া হারাম, কিন্তু দাবাগাত-প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা তো হারাম নয়। (বুখারি, হাদিস নম্বর ১৪৯২; মুসলিম, হাদিস নম্বর ৩৬৩।) বুখারির অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘উম্মুল মোমিনিন সওদা (রা.) বলেন, ‘একটি ছাগল মরে গেলে আমরা তার চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে মশক বানিয়ে ব্যবহার করি এবং তাতে খেজুরের শরবত পান করি।’ পরিসমাপ্তিতে একথাই স্বতঃসিদ্ধ যে, জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাওয়া জায়েজ বিধায় আরোগ্যের জন্য প্রতিষেধক হিসাবে শূকরের চর্বি ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ব্যবহার জায়েজ হবে ।الله اعلم بالصواب

লেখকঃপ্রভাষক মুহাম্মাদ আসাদুজ্জামান ফারুকী খতিব, কলারোয়া থানা জামে মসজিদ। কলারোয়া, সাতক্ষীরা।

About The Author

Related posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি থেকে বিরত থাকুন,ধন্যবাদ।