রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ
শুধু মুখে নয়, অন্তরেও থাকুক বঙ্গবন্ধুর দর্শন
শুধু মুখে নয়, অন্তরেও থাকুক বঙ্গবন্ধুর দর্শন

শুধু মুখে নয়, অন্তরেও থাকুক বঙ্গবন্ধুর দর্শন


লেখক – ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক 
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ টানা ২৩ বছরের বাঙ্গালীরসংগ্রামী মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি নাম নয় বরং একটি দর্শন। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি, স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়া, অঙ্গীকার ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টে  বর্বরোচিত ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম  হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী পরে  সেই দর্শনের কতটুকু আমরা মুখে আর কতটুকু বুকে ধারণ করি এটাই এখন বড় প্রশ্ন? 
বঙ্গবন্ধুর এক তর্জনীর তীরে জেগে উঠেছিল  সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার লাল সবুজের পতাকা, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন ভূখন্ড ।  বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল, মহানুভব ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এডওয়ার্ড হিথ, ফিদেল কাস্ত্রো, ইয়াসির আরাফাত থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা খুলে সমালোচিত হওয়ার জবাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে  বলেছিলেন, ‘আমি কোনো দেশের সরকার প্রধানের গাড়ির দরজা খুলে দিইনি বরং বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এক মহান নেতার গাড়ির দরজা খুলে ব্রিটিশদের সম্মানিত করেছি। শুধু তাই না নোবেল বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন ‘আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব ও কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বিশেষত্ব।’ কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ এই হচ্ছেন নির্যাতিত নিপীড়িত  মানুষের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর বঙ্গবন্ধু । তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে  সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়।
১৯৭৫-এর পরে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও আদর্শ  বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তার নাম মুছে ফেলার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু তার যোগ্য  কন্যা শেখ হাসিনা লড়াই-সংগ্রাম করে  রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে থাকে। তবে টানা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায়  মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা সুবিধাবাদীদের সংখ্যা হু হু করে বাড়লেও বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চার লোক কতোটা বেড়েছে? শোকের মাসে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোক কতটা মুখে, আর কতটা অন্তরে ? সারাদেশে এখন শুধু সুবিধাবাদী আওয়ামীলীগের জয়জয়কার, তাই প্রকৃত মুজিব প্রেমিদের মনে  প্রশ্ন জাগে এরা কারা? এরা কি সত্যিকার অর্থেই মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হাতিয়ার – নাকি মুস্তাক গং এর মতো সুবিধাবাদী গুপ্তচর?
ইদানীং জাতীয় শোক দিবসে ফেসবুক কিংবা  পোস্টার, ব্যানার, কাঙ্গালী ভোজ ও বিদেশি গানের সাথে হৈ-হুল্লোড খুব সহজে দেখা যায়, দেখানো যায়। এসব দিয়ে শোক প্রকাশ করা যতটা সহজ, বুকের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ, বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের চর্চা সেই তুলনায় একটু কঠিন। হতাশার বিষয় এই দেশে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে আমলা, কামলা, শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী ও নানা পেশাজীবী লোকজন শোক প্রকাশের জন্য আদর্শের প্রকৃত চর্চা না করে সহজ পথটা বেচে নেয়।  প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ কী? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে তার দেশ্রপ্রেম, আপোসহীনতা,  সততা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, কুসুম কোমল হৃদয় । বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন বলেই সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলতে পেরেছিলাম  , ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনকাল ছিল দেশ ও জনগনের  কল্যাণে , যেখানে ছিল না কোনো বিলাসিতা, ছিল না অর্থের লোভ, ছিল না হিংসা-বিদ্বেষ। ছিল শুধু দেশের জন্য ও সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা  ভরা এক বিশাল হৃদয়। তাই শোকের মাসে শক্তি হোক – শুধু বক্তৃতায়  নয়, মুজিব আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হোক প্রত্যেকের কর্মে। 
৭ই মার্চের ভাষণের মত ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু  বলেছিলেন  প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলতে।  শুধু কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেই তো দেশপ্রেম, সততা, সহমর্মিতা, আপসহীন কুসুম কোমল হৃদয় । ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে রাজনীতিবিদ, আমলা-কামলা, ব্যবসায়ী, সুশীল  যারা দুর্নীতি করে,  টাকা পাচার করে, প্রতারণা করে, চাঁদাবাজি করে  তারাতো আসলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে, এরা মোস্তাক গং এর অনুসারী, অনুপ্রবেশকারী নয় কি? 
১৯৭১ সালে যে  তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলো  এক আদর্শের নাম। যার ত্যাগ, আদর্শ, সততা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের মোহনীয়তার জাদুর ছোয়ায় ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি তরুণ ছিনিয়ে এনেছিল  স্বপ্নের স্বাধীনতা। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, আদর্শ, স্বপ্ন, ঔদার্য, সারল্য, নির্ভেজাল বাঙালিত্ব, আত্মমর্যাদা, মানবিকতা, অসীম  সাহস, নির্মোহ আত্মসমালোচনা, অপরিসীম দেশপ্রেম, ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব ও প্রবল ধীশক্তি  ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চিরভাস্বর হয়ে ছিলো তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে, অস্তিত্বে, চেতনার অস্থিমজ্জায়।  সেই তরুন প্রজন্মের যোগ্য  উত্তরসূরিদের কাছে বাঙ্গালীর  অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও অনুপ্রেরণার বাতিঘর বঙ্গবন্ধু এখন কতটা মুখে আর কতটা অন্তরে?

About The Author

Related posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি থেকে বিরত থাকুন,ধন্যবাদ।